ভালোবাসার মোড়কে কেন অশ্লীলতা?

মোজাম্মেল হক আলম :
আজকের প্রজন্মের কাছে বহুল কাক্সিক্ষত দিন ‘ভালোবাসা দিবস বা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে’। এটি প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি অশ্লীলতা, বেহায়াপনা প্রেম এবং অনুরাগের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। দুনিয়াজুড়ে তারা এ দিনটিকে অত্যন্ত আগ্রহ ও আনন্দের সঙ্গে পালন করে আসছে। তারুণ্যের অনাবিল আনন্দ আর বিশুদ্ধ উচ্ছ্বাসে সারাবিশ্বের মতো ভ্যালেন্টাইনস ডে ক্রেজ আমাদের দেশেও দিন দিন বিপদজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কথিত ‘ভালবাসা দিবস’কে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যের অনুকরণে ৯৫ ভাগ মুসলমানের এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও উচ্ছৃংখল মুসলিম ছেলে-মেয়েরাও এ অশ্লীল ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দিয়ে থাকে। হৈ চৈ, উন্মাদনা, রাঙায় মোড়া ঝলমলে উপহার সামগ্রী, নামি রেস্তোরাঁয় ‘ক্যান্ডেল লাইট ডিনার’ কে ঘিরে প্রেমিক যুগলের চোখেমুখে এখন বিরাট উত্তেজনা। হিংসা-হানাহানির যুগে ভালোবাসার জন্য ধার্য মাত্র এই একটি দিন! প্রেমিক যুগল তাই উপেক্ষা করে সব চোখ রাঙানি। বছরের এ দিনটিকে তারা বেছে নিয়েছে হৃদয়ের কথকতার কলি ফোটাতে। কী এই ভ্যালেন্টাইনস ডে? কীভাবে তার উৎপত্তি? কেনইবা একে ঘিরে ভালোবাসা উৎসবের আহ্বান? আসুন তরুণ বন্ধু এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজি।
ভ্যালেন্টাইস ডে-র ইতিহাস: ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খৃস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে তৎকালীন রোমান স¤্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সা¤্রাজ্যে খৃস্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। সেই দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন। খৃস্টানজগতে পাদ্রী-সাধু সন্তানদের স্মরণ ও কর্মের জন্য এ ধরনের অনেক দিবস রয়েছে। খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উৎসব নিষিদ্ধ হয়।
আমাদের দেশে দিনটির শুরু: ১৯৯৩ সালের দিকে আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে। জনৈক সাংবাদিক লন্ডনে পড়াশোনা করেছিলেন। এ সুবাধে পাশ্চাত্যের রীতিনীতিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। দেশে ফিরে তিনিই ভালোবাসা দিবসের শুরুটি করেন। এ নিয়ে অনেক ধরনের মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার চিন্তাটিই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করে। সে থেকে আমাদের দেশে দিনটির শুরু। উল্লেখ্য, যে রোম শহর তথা ইতালিতে বর্তমানের কথিত ভালোবাসা দিবসের জন্ম সেই ইত্যালিতেই দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী এ দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ ছিল।
কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপে এবং ইউরোপ থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮শ’ শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে ছাপানো কার্ড প্রেরণ। এ সব কার্ডে ভালো-মন্দ কথা, ভয়-ভীতি আর হতাশার কথাও থাকত। ১৮শ’ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যে সব কার্ড ভ্যালেন্টাইন ডে’তে বিনিময় হ’ত তাতে অপমানজনক কবিতাও থাকত।
কথিত ভালোবাসা দিবসে ভালবাসায় মাতোয়ারা থাকে আমাদের রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো। পার্ক, রেস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া, পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর হল রুম, বল রুম- সর্বত্র থাকে প্রেমিক-প্রেমিকারূপী অশ্লীল ভালোবাসা ভিখারীদের তুমুল ভিড়। প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশের অগণিত তরুণ-তরুণী ভ্যালেন্টাইনস ডে পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ দিনে তারা পাঁচতারা হোটেলে, পার্কে, উদ্যানে, লেকপাড়ে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে ভালোবাসা বিলায়, অথচ তাদের নিজেদের ঘর-সংসারে ভালোবাসা নেই! আমাদের বাংলাদেশী ভ্যালেন্টাইনরা যাদের অনুকরণে এ দিবস পালন করে, তাদের ভালোবাসা ‘জীবনজ্বালা’ আর ‘জীবন জটিলতা’র নাম; মা-বাবা, ভাই-বোন হারাবার নাম; নৈতিকতার বন্ধন মুক্ত হওয়ার নাম। তাদের ভালোবাসার পরিণতি ‘ধর ছাড়’ আর ‘ছাড় ধর’ নতুন নতুন সঙ্গী। তাদের এ ধরা-ছাড়ার পালা চলতে থাকে জীবনব্যাপী। বছর ঘুরে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের ভালোবাসায় রাঙিয়ে গেলেও, ভালোবাসা কিন্তু প্রতিদিনের। জীবনের গতি নির্ধারণ করে ভালোবাসা। মানুষ বেঁচে থাকে ভালোবাসায়। বছরে মাত্র একটি দিন ও রাত প্রেম সাগরে ডুব দেয়া, সাঁতার কাটা, চরিত্রের নৈতিক ভূষণ খুলে প্রেম সাগরের সলিলে হারিয়ে যাওয়ার কি কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে? ইসলামী নৈতিকতা ও ইসলামী আদর্শের প্রতি উদাসীনতার কারণে সমাজে অশান্তি, অরাজকতা ও বিচ্ছৃংখলা বেড়েই চলেছে। ভেঙ্গে পড়েছে সামাজিক বন্ধন, পারস্পরিক সহানুভূতি, সৌহার্দ্যতা ও শ্রদ্ধাবোধ।
এই দিনে এক শ্রেণির মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে ফুল, চিঠি, কার্ড, গহনা প্রভৃতি উপহার প্রদান ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উচ্ছৃংখল জীবনের সাথে গা ভাসিয়ে দেয়াকেই প্রকৃত ভালোবাসা মনে করে। অথচ ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর কোমল দুরন্ত মানবিক অনুভূতি। ভালোবাসা নিয়ে ছড়িয়ে আছে কত কত পৌরাণিক উপাখ্যান। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি সর্বত্রই পাওয়া যায় ভালোবাসার সন্ধান। ভালোবাসার জন্য মানুষ মৃত্যুকে তুচ্ছ করে। রাজা সিংহাসন ত্যাগ করে হাসিমুখে প্রেমিকার হাত ধরে। আজকের এই পাথর সময়ে ঈর্ষা-বিদ্বেষ আর হানাহানির পৃথিবীতে ভালোবাসা প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলেছে অমর্ত্যলোকের কাহিনী। কিন্তু প্রত্যেক মু’মিনের ভালোবাসার একমাত্র প্রধান কেন্দ্র হলো মহান আল্লাহ এবং তাঁর প্রিয় রাসূল (সা.)। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ইত্যাদি সকলের প্রতি ভালোবাসার মূল ভিত্তি হবে আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসার পরিপূর্ণতার জন্য।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে আজকাল অনেক মুসলিমই প্রকৃত বিষয়টি না জেনে নানা রকম বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করে থাকে। তারা কেবল তাদের সাংস্কৃতিক নেতাদের মতোই এসব ক্ষেত্রে অন্ধ অনুসারী। তারা এটি খুবই কম উপলব্ধি করে যে, তারা যা নির্দোষ বিনোদন হিসেবে করে তার শিকড় আসলে পৌত্তলিকতায়, যা তারা লালন করে তা কুসংস্কার থেকেই জন্ম। ভালোবাসা দিবস আমেরিকা ও ব্রিটেন বাদে গোটা ইউরোপে মৃত হলেও হঠাৎ করেই তা মুসলিম দেশগুলোয় আবার প্রবেশ করছে। কিন্তু কার ভালোবাসা? কেন এ দিবস পালিত হবে?
এ দিনটিকে যদি ভালোবাসা দিবস হিসেবেই পালন করতে হবে তবে ভালোবাসা দিবসের ইংরেজি হওয়া উচিত ছিল ‘লাভ ডে’ অথবা ‘লাভার্স ফেস্টিভাল ডে’। অথচ আমরা যাকে ভালোবাসা দিবস বলে উদযাপন করছি, সেটার উৎপত্তিগত নাম ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। এর প্রথম শব্দটিই এ দিনটির আসল পরিচয়ের জানান দিতে যথেষ্ট। অতএব ভ্যালেন্টাইনস্ ডে’র বৃত্তান্ত জেনে এ দিনে ভালোবাসার আবরণে অশ্লীলতা চর্চা বন্ধ হোক, এটাই আমার প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

     আরো পড়ুন....

পুরাতন খবরঃ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
error: ধন্যবাদ!